Saturday, August 05, 2006

গল্প নয়ঃ পুরুষিনী, তৃতীয় প্রকৃতি এবং বহু উভচর মানুষ

অনেক দিন আগের কথা (৩,০০,০০০+ দিন), আয়াজকে জিজ্ঞাসা করলেন মাহমুদ, "আমার চেয়ে বড় কোন সম্রাট কেউ আছে?", আয়াজ উত্তর দিলেন, "নিশ্চয়ই আমিই তো তোমার চেয়ে শ্রেয়তর সম্রাট"। মাহমুদ প্রমান চাইলেন, আয়াজ বললেন, "যদিও তুমি একজন সম্রাট, কিন্তু তোমার হৃদয় তোমার ওপর কর্তৃত্ব করে, আর এই দাস তোমার হৃদয়ের সম্রাট"। এ অংশটুকু ফরিদ উদ্দিন আত্তারের এলাহীনামা থেকে নেয়া। মাহমুদ হচ্ছেন গজনীর সুলতান মাহমুদ, যিনি পারস্য, আফগানিস্থান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তরাংশের অধিপতি ছিলেন একাদশ শতাব্দিতে। আর আয়াজ? মালিক আয়াজ একজন দাস, এক পর্যায়ে লাহোরের অধিপতি এবং সুলতান মাহমুদের lover। মাহমুদ এবং আয়াজের ভালোবাসা নিয়ে বেশ কিছু সুফী সাহিত্য আছে (উত্সাহী পাঠকরা পড়ে দেখতে পারেন), তবে আমি আপাতত সুফীবাদ এবং ইতিহাস থেকে দৃষ্টি ফেরাতে চাচ্ছি আরেকটা জাগতিক প্রশ্নের দিকে। মাহমুদ এবং আয়াজ দুজনেই তো পুরুষ, তাদের মধ্যে আবার ভালোবাসা কি? এক হাজার বছর আগে সমকামীতা ছিল না কি? কারন সমকামীতাতো পাশ্চাত্যের বিকৃত নরনারীর ফ্যাশন।

আমরা বড় হয়ে ওঠার সময় বিশেষ করে ৫-১২ বছর বয়সের সময়ে অনেক সামাজিক মুল্যবোধ এমন ভাবে প্রোথিত হয়ে যায়, যে পরে মুল্যবোধগুলো আমাদের পরিচয় এবং স্বত্ত্বার অঙ্গ হয়ে দাড়ায়। যেমন বাঙালী শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে মাঝ বয়সী লোক আর কিশোরীর প্রেমকে কখনই সহজভাবে দেখতে অভ্যস্ত নই (হুমায়ুন আহমেদ নিয়ে ব্লগের ঝগড়াঝাটি দ্রঃ), অনেক ক্ষেত্রেই এগুলোকে অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ বলে মনে করি। অথচ ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখব আমাদের প্রাতঃস্মরনীয় অনেক বীর, ধর্মীয় নেতা , রাজনৈতিক গুরু এই কাজটি অবলীলায় করে গেছেন, আমি নিজেও এর মধ্যে দোষের কিছু দেখি না, প্রেম তো আর বয়স মানে না, কিন্তু প্রেম কি লিঙ্গভেদ মেনে চলে, অথবা যৌনতা?

আসলে নৈতিকতার অনেকটাই সামাজিক মুল্যবোধ থেকে এসেছে। যেমন আরব সমাজে বয়ষ্ক পুরুষ এবং বালকের মধ্যে যৌন সম্পর্ক গ্রহনযোগ্য তো বটেই মধ্যযুগে (ইসলামের বিস্তৃতির সময়) বহুল প্রচলিতও ছিল। কোরানে বেহেশতের প্রসঙ্গে আছে "And there shall wait on them (the Muslim men) young boys of their own, as fair as virgin pearls." (Qur’an 52:24; 56:17; 76:19)। তবে শুধু ইসলামী সমাজে নয়, এর বাইরেও সমকামীতা সবসময়ই মানব সমাজে ভালোভাবেই ছিল। গ্রীক, রোমান, চৈনিক, পাপুয়া নিউ গিনি অথবা উত্তর আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতায় সমকামীতার ভুরি ভুরি উদাহরন আছে। হিন্দু পুরানেও এরকম বেশ উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন পুরুষীনি অথবা তৃতীয় প্রকৃতি। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে সমকামীতা আধুনিক পশ্চিমাদের আবিষ্কার নয়, বরং এমন কিছু যা আমাদের ভেতরেই আছে, পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর উন্মুক্ত তথ্য প্রবাহের কারনে ইস্যুটা জনসমক্ষে চলে এসেছে।

সত্যিই কৌতুহলী হতে হয়, দুটি বিপরীত লিঙ্গের অস্তিত্ব থাকার পরেও সমলিঙ্গে আকর্ষনের দুর্ঘটনার কারন কি? এখানে বলে রাখা ভালো, দুই লিঙ্গের অস্তিত্ব কোন চিরন্তন সত্য নয়, বহু প্রানী আছে যাদের একটাই লিঙ্গ। মানুষের বাইরে বাইসন, ভেড়া, পেঙ্গুইন, গরু, ডলফিন, বিশেষ করে শিম্পাঞ্জীদের মধ্যে সমকামীতা প্রচলিত (ওদের অবশ্য পরকালে শাস্তির ভয় নেই)। সমকামীতার কারন নিয়ে অনেক গবেষনা হয়েছে এবং হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রমান দেখানো হয়েছে সমকামীতা আসলে জেনেটিক। কিছু গবেষনায় পাওয়া গেছে পুরুষ সমকামীদের মস্তিষ্কের গঠন আসলে বিষমকামী (heterosexual) মেয়েদের মতো। এসব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে এবং গবেষনাও চলছে, সামনের বছরগুলোতে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।

তবে বেশীরভাগ বিজ্ঞানীরাই
Alfred Kinseyর গবেষনার সাথে সহমত পোষন করেন- মানব জাতির অধিকাংশ সদস্যই আসলে উভগামী (bisexual), ঠিক পুরোপুরি সমকামী বা বিষমকামী আসলে সংখ্যায় কম। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনায় দেখা গেছে মার্কিন মেয়েদের ৪%, এবং ছেলেদের ৫% জীবনের কোন না কোন সময় সমকামীতার চর্চা করেছে (এক বা একাধিকবার)। আমাদের দেশেও মাদ্রাসা, বোর্ডিং ষ্কুলে এসব ঘটনা ভালোই প্রচলিত। সরাসরি যৌন সম্পর্ক ছাড়াও উভচর প্রবৃত্তির আরও বহির্প্রকাশ আছে, যেমন ছেলেদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব যেখানে একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে আস্থা পুনর্প্রতিষ্ঠিত করে, একটু প্যাসিভ তবে প্রেরনা মনের ভেতর থেকেই আসে। একসময় সেনাবাহিনীতে ঐক্য অটুট রাখার জন্য এধরনের সম্পর্ক উত্সাহিত করা হতো।

বৃত্তের বাইরে চিন্তা করে অভ্যস্ত নই বলে আমাদের অনেকে সমকামীতা নিয়ে অহেতুক সংকটে ভুগতে থাকি, আসলে সমকামীতা, উভগামীতা, বিষমকামীতা সবগুলোই মানুষের জীবনের অংশ, প্রয়োজন শুধু দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের।

বিঃদ্রঃ লেসবিয়ানদের সংখ্যা সাধারনত গে দের চেয়ে কম। সিনেমায় লেসবিয়ানদের বেশী দেখা যায় কারন, বেশীর ভাগ বিষমকামী পুরুষ লেসবিয়ানদের নিয়ে ফ্যান্টাসীতে ভোগে। পর্ন ছবির একটা বড় অংশ লেসবিয়ানদের নিয়ে, এবং এদের দর্শক রেগুলার পুরুষরা।

0 Comments:

Post a Comment

<< Home

eXTReMe Tracker