Saturday, May 13, 2006

মিম (meme) , ধর্ম এবং সংষ্কৃতি

মিম, শব্দের বয়স ত্রিশের কিছু বেশী, আমি নিজেও প্রথম শুনলাম দু বছর আগে। মিম অবশ্য যা বোঝায় তা মোটেই পুরোনো নয়, সত্যি বলতে কি মিমের ব্যখ্যা নিজেই একটা মিম, বইয়ে (দ্রঃ - ১) প্রথমবার পড়ে মনে হচ্ছিল এই মিমকে না ছড়ানো পর্যন্ত শান্তি নেই, আগে পরিচিতদেরকে বলেছি, এখন সম্ভব হলে ব্লগ পাঠকদের মধ্যে ছড়াব।

মিমের একটা কাছাকাছি শব্দ জিন (gene), এখন বহুল প্রচলিত, অনেকটা মিমের বায়োলজিকাল সমার্থক। তবে মিমের অর্থ পরিষ্কার করার জন্য ভাইরাসের উদাহরন ব্যবহার করলে ব্যপারটা আরো সহজবোধ্য হবে। আমি সংক্ষেপে বলব, অনেকে আরও বিস্তারিত ভাবে বলতে পারবেন। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি ভাইরাসের মতো ক্ষুদ্র এবং তুলনামুলক ভাবে সরল বায়োলজিকাল ইউনিট কিভাবে আমাদের মতো জটিল, well equipped প্রানীকে সহজেই কাবু করে ফেলে, উত্তরটা জানতে হলে ভাইরাস কিভাবে কাজ করে জানতে হবে। ওহ আরেকটা ব্যাপার বায়োলজিকাল ভাইরাস আর কম্পিউটার ভাইরাসের স্ট্র্যাটেজি মোটামুটি একইরকম। এসব ভাইরাসের আক্রমনের দুটি স্তর, প্রথম স্তর হলো কোনো ভাবে host কোষে ঢুকে পড়া, কিন্তু ঢুকে পড়াটা অত সহজ নয়, কারন কোষের দেয়াল আছে, এবং দেয়ালের প্রোটিন বাইরের অচেনা জিনিসকে ঢুকতে দেবে না, অনেকটা প্রি-প্রোগ্রামড, আর এই প্রি-প্রোগ্রামড বলেই এর মধ্যে ভুলও আছে (কম্পিউটারের ক্ষেত্রে security hole) , যদি কোন ভাইরাসের কাছে এমন অন্য একটি প্রোটিন (অথবা কোড) থাকে যা এই ভুলকে সফলভাবে exploit করতে পারে তাহলেই কেল্লা ফতে, ভাইরাস কোষের ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেয়ে যাবে। সর্দির ভাইরাস থেকে শুরু করে বার্ড ফ্লু সবার টেকনিক মোটমুটি একই রকম। এরপর শুরু হয় আক্রমনের দ্বিতীয় স্তর, আমাদের কোষের মধ্যে যথেষ্ট যন্ত্রপাতি আছে যারা ভাইরাস তৈরীর উপাদান গুলো উত্পাদন করতে পারে (কারণ ভাইরাসের মৌলিক উপাদান আর আমাদের শরীরের মৌলিক উপাদান একই), সহজ ভাষায় বলতে গেলে ভাইরাস এদেরকে এমনভাবে মোটিভেট করে যে এরা নিয়মিত কাজকর্ম ফেলে ভাইরাস তৈরী করা শুরু করে দেয়, এবং অল্পক্ষনেই শত শত ভাইরাস তৈরী হয়ে কোষের দেয়াল ভেঙ্গে বের হয়ে আসে, আর আশেপাশের কোষগুলোকে আক্রমন করে। যে ভাইরাস যত ভালোভাবে নিজেকে copy করতে পারে (বা যতটা স্বার্থপর), সে তত সফল। জিন (gene) যদিও আক্ষরিক অর্থে কাউকে আক্রমন করছে না, তবে সেও তার হোস্টকে (প্রানী নিজেই) ম্যানিপুলেট করে নিজের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য, আমি বিস্তারিততে যাব না আজকে। এখন মিমের প্রসঙ্গে ফিরে আসি, মিম ভাইরাস বা জিনের মতোই তবে এর হোস্ট হচ্ছে মন বা মস্তিষ্ক (শুধু মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ নয়)। উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে, যেমন গুজব হলো এক ধরণের মিম। এই মিম ছড়াতে পারে এভাবে, আপনি হয়ত কোন শোবিজ স্টারের খুব খোজখবর রাখেন, আমি আপনাকে তার সম্পর্কে কিছু চটকদার খবর দিলাম, আপনি শুনে এতই মোহিত ( মিম প্রথম স্তর সফল ভাবে পার হলো), পরক্ষনেই বান্ধবীকে জানালেন, বাসা গিয়ে ভাই বোন কে জানালেন, রাতে চ্যাট করে জানালেন আরও বন্ধু বান্ধবকে (copy সফল), এবং আপনি যাদেরকে বলেছেন তারাও মোটামুটি একই ভাবে ছড়াতে লাগলো, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আরেকটা ব্লগীয় উদাহরণ, কয়েকদিন আগে অরূপ শাখামৃগ নিয়ে একটি বিশেষ ছবি সহ পোস্ট করার প্রস্তাব করল, আর যায় কোথা আমুদে লোকজন লুফে নিল প্রস্তাব, মিম-এ ইনফেকটেড কেউ কেউ লেখা ছাড়ল, বাকী ইনফেকটেডরা (আমার মতো) দিনে বহুবার লগ ইন করলো লেখা পড়ার জন্য। ফ্যাশন, ট্রেন্ড, গল্প, কবিতা, এমনকি ব্লগ, সবই এক বা একাধিক মিম। মিম নিজে ভালো বা খারাপ নয়, তবে হোস্টের ওপর এর প্রভাব ভালো, খারাপ হতে পারে। জিন বা ভাইরাসের মতো ডারউইনের সুত্র মিমের ওপরও প্রযোজ্য (survival of the fitest)। সবল মিম দুর্বল মিমকে হটিয়ে দেয় (পুরোনো ফ্যাশন আর চলেনা নতুন ফ্যাশন এলে)। যেসব মিম খুব ভালো ভাবে আমাদেরকে exploit করতে পেরেছে, এবং যাদের copy fidelity খুব ভালো, তারা যুগ যুগ টিকে যায় (যেমন রবীন্দ্র সাহিত্য)। আরো মিম আছে যারা এর চেয়েও বেশী দিন ধরে টিকে আছে, যেমন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস, ধর্ম। ধর্ম আমাদের চমত্কার কিছু দুর্বলতা খুজে বের করেছে (যেমন, মৃত্যু ভয়, অজানা ভবিষ্যতের আশংকা, আমার মনে আছে ছোটবেলায় পরীক্ষা বা ফলাফলের আগে খোদার দরবারে মোনাজাত বেড়ে যেত), আবার এই দুর্বলতা গুলো প্রায় সার্বজনীন হওয়ায় copy fidelity খুব ভাল। ধর্মের মৌলিক ধারণা গু লো (মিম গুলো) এ জন্য বহুদিন ধরে টিকে আছে। তবে এই মিমগুলোর অনেক ভ্যারিয়ান্ট আছে , এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ভ্যারিয়ান্ট গুলো মুল ধারনার বাইরেও আরো অনেক কিছু যোগ করে, যেমন প্রাত্যাহিক উপাসনা, উত্সব স্রেফ মিমের survival নিশ্চিত করতে। মিম যদি কোন হোস্ট খুজে না পায়, তাহলে মিমের মৃত্যু হবে, মিম সংশ্লিষ্ট আইডিয়া সমেত। যেমন, গ্রীক দেব দেবীদের ধর্মিয় মিম, কেউ যেহেতু এই দেব দেবীদের বাস্তব অস্তিত্বে আর বিশ্বাস করে না, এই মিমেরও আর অস্তিত্ব নেই, আক্ষরিক অর্থেদেবরাজ জিউসের মৃত্যুও এই সাথেই হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস ভিত্তিক মিমের এই একটা সমস্যা বিশ্বাসী না থাকলে মিম তার উপাদান সমেত (দেবতা, সৃষ্টিকর্তা, ...) মরে যেতে বাধ্য। ধর্মীয় মিম এজন্য যুক্তিবাদী খোজে না বরং খোজে অন্ধ বিশ্বাসী।

0 Comments:

Post a Comment

<< Home

eXTReMe Tracker