মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ-১.১
ইতিহাস যখন কাহিনী আকারে পড়ি, প্রায়ই যে ঘটনাটা ঘটে তা হলো চরিত্রগুলোকে মনের অজান্তে সাদা-কালোয় বিভাজিত করে ফেলি। কেউ ভালো আর কেউ খারাপ। ইতিহাসের সংঘর্ষগুলো হয়ে দাড়ায় শুভ-অশুভের নিরন্তর অতি পরিচিত সংগ্রামের কেবলই একটি দৃশ্য মাত্র, শুধু স্থান-কাল-পাত্র-পাত্রীরা বদল হয়। হয়তো এসব অতি সরলীকরনের অনেক সুবিধা আছে, সমস্যা হচ্ছে রwঙন ছবিকে সাদা-কালো করলে যা হয়, অনেক মৌলিক তথ্য বাদ পড়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯- ১৯৪৫) নিয়ে অনেক সিনেমা, ডকুমেন্টারী, বা টিভি সিরিজ দেখেছি, গল্প আলোচনাও কম করি নি, তারপরও একটা গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন কখনও ভালোভাবে মনে আসেনি, প্রশ্ন করার আগেই যখন উত্তরটা পেলাম তখন বুঝতে পারলাম শুধু আমি না অনেকেই এই অতিসরলীকরনে আক্রান্ত হয়েছে। আমার কলিগের বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হল্যান্ডে থাকতেন, একদিন কথায় কথায় তিনি বললেন, যুদ্ধের পরে তাদের অনেক আত¥ীয় স্বজন দক্ষিন আফ্রকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, কারন যুদ্ধে তাদের অনেকে জার্মান বাহিনীকে সাহায্য করেছিলেন। খুব আশ্চর্য হলাম এটা শুনে, কারন আমি আমার কলিগদের ফ্যামিলিকে জানতাম সত্, ভদ্র, এবং অনেকটাই উদার মনোভাবের মানুষ হিসেবে, তারা কিভাবে সাক্ষাত ডেভিল হিটলারের লোকজনকে সাহায্য করলেন পরিষ্কার হচ্ছিল না। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করেছি, অনেক তথ্য পেলাম যেগুলো সচরাচর সিনেমা, বা ডকুমেন্টারীতে থাকে না। প্রচলিত বর্ণনায় হিটলার, আর তার সাঙ্গপাঙ্গদেরকেই শুধু কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়, যে তথ্যটা থাকে না তা হলো, যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতি ৩/৪ জন জার্মান পুরুষ নাগw রকের একজন সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে, অনেকক্ষেত্রেই সাধারন জনগন প্রত্যক্ষভাবে গনহত্যায় ভুমিকা রেখেছে, এবং জার্মানী যখন ডেথ ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ বন্দিকে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে মেরে ফেলছিল তখন নাগরিকরা কোন প্রতিবাদ তো করেই নি বরং অনেকেই যুদ্ধবন্দিদেরকে দাস হিসেবে কলকারখানায় কাজ করিয়েছে। জার্মানী যখন একটার পর একটা দেশ দখল করছিল দেশপ্রেমিক জার্মান নাগরিকরা সেটাকে ভালোভাবেই সেলিবেªট করত। হিটলার না হয় নরপিশাচ ছিল, তাই বলে কি দেশশুদ্ধ মানুষের কি কোন বিবেক বুদ্ধি ছিল না? এখানেই সরলীকরনের সমস্যা, টিভি সিনেমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে এসব উত্তর পাওয়া মুশকিল, বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষন দরকার। ঐতিহাসিক চরিত্র গুলোকে পিশাচ আর ফেরেশতায় ভাগ না করে তাদের নির্মোহ বিশ্লেষন করলে বুঝতে পারব উত্তরগুলো যথেষ্ট জটিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারার পর জার্মানীতে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় (Weimer Republic), যদিও দেশের তখনকার রাজনৈতিক দলগুলোর গনতন্ত্রে আস্থা ছিল না বললেই হয়। এরকম অবস্থায় চরম ডান (Nationalsozialistische Deutsche Arbeiterpartei বা নাত্সী পার্টি) এবং চরম বাম দুধরনের দলের বিস্তার ঘটে, সবদলেরই আবার পেটোয়া বাহিনী (প্রচলিত বাংলায় ক্যাডার) ছিল যেমন নাত্সীদের ক্ষেত্রে SA, SS (Schutzstaffel) বাহিনী। নাত্সী বাহিনীর মুল ভিত্তি ছিল জার্মান জাতীয়তাবাদ, আরো ভালোভাবে বললে বর্ন ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, হিটলারের Mein Kampf (My Struggle) বইয়ে বিশদভাবে এসব [ইংলিশ]ত্ধপরংঃ[/ইংলিশ] বর্ণনা আছে। যাহোক ত্রিশের দশকের শুরতে অর্থনৈতিক মন্দার কারনে এসব বক্তব্য জার্মান নাগরিকদের কাছে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত মনে হতে থাকে, শেষমেশ ১৯৩২ সালে হিটলার বৈধ ভাবেই ক্ষমতারোহন করে।
পরবর্তি কয়েক বছরে হিটলারের বর্ণভিত্তিক বিশেষ করে ইহুদি এবং জিপসী বিরোধী প্রচারনা বাড়তে থাকে, ইহুদি বিরোধী সভা সেমিনার ইত্যাদি চলতে থাকে (সাম্পÖতিক কালে যেমন বাংলাদেশে কাদিয়ানী বিরোধী কার্যকলাপ, একসময় আমরা সমস্যাটা জানতামই না, আবার যখন ওদেরকে আক্রমন করা হলো সাধারন জনগন হিসেবে আমরা কেউ বাচাতেও গেলাম না, একইরকম দেখি অনেক পশ্চিমা মাধ্যমে অবাধ মুসলিম বিরোধী প্রচারনা , যা সাধারন নাগরিকরা সচরাচর প্রতিবাদ করে না)। একসময় জার্মানীতে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার সংকোচন চলতে থাকে। অবস্থা এমন দাড়ায় জার্মানীতে ইহুদিদেরকে সরিয়ে নিয়ে ঘেটোতে (ghetto - যেমন মোহাম্মাদপুরে বিহারী ক্যাম্প) বন্দি করা হয়। জার্মানী বিশ্বযুদ্ধ শুরু করলে যে সব দেশ দখল করছিল, সেখান থেকে ইহুদি, জিপসীদেরকে নিয়ে এরকম ঘেটো বা concentration ক্যাম্পে নিয়ে জড়ো করা হতে থাকে। জার্মান শিল্পপতিরা সোল্লাসে এদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে, উদাহরণ Friedrich Flick এবং তার DaimlerChrysler (এদের বানানো গাড়ীর মধ্যে আছে Chrysler, Dodge, Jeep, Mercedes-Benz) কোম্পানী। Forced slave labor জার্মানীর জন্য শিল্প বিকাশে খুবই সুবিধাজনক হয়ে দেখা দেয়, এমনকি যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে (১৯৪৩-১৯৪৫) জার্মানী যুদ্ধ সরঞ্জামের উত্পাদন কয়েকগুন বাড়াতে সক্ষম হয় কেবল যুদ্ধবন্দিদের ওপর ভিত্তি করে।
১৯৪২ সালে নাত্সী জার্মানী সিদ্ধান্ত নেয় সমস্ত ইহুদী, জিপসীদেরকে মেরে ফেলার (Endlösung der Judenfrage)। এই সিদ্ধান্ত মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গনহত্যার সুচনা করে। জার্মানরা গনহত্যাকেও industrialized করে নেয়, ইউরোপ জুড়ে extermination camp তৈরী হতে থাকে। ডেথ ক্যাম্পগুলোর বর্ণনা এতই বিভত্স এবং একই সাথে এতই করুন আমি পাঠকদের অনুরোধ করব নীচের লিংকগুলো পড়ে দেখতেঃ
http://www.holocaust-history.org/
http://www.holocaustsurvivors.org/
প্রথমে ভেবেছিলাম বাংলায় অনুবাদ করে লিখব, কিন্তু বর্ণনা এবং ছবি গুলো এতই overwhelming যে আমার পক্ষে পুরোপুরি তুলে ধরা অসম্ভব। শুধু পরিসংখ্যান হিসেবে লিখলে হয়তো আমার জন্য সহজ হবে, ডেথ ক্যাম্প গুলোর মধ্যে Belzec-এ দিনে ১৫০০০ , Sobibor-এ ২০০০০, [ইংলিশ]ঞত্বনষরহশধ[/ইংলিশ] তে ২৫০০০, Majdanek তে দিনে ২৫০০০ লোক মেরে ফেলা হতো। সংখ্যাগুলো এত বড় মানুষ হিসেবে বুঝতে কষ্ট হয়, যারা এই হত্যাকান্ডগুলো ঘটিয়েছে তারা কেমন ছিল।
নাত্সী SS বাহিনী এই হত্যাকান্ডের দায়িত্বে ছিল, জার্মান আর্মি কোন এলাকা দখল করলেই এরা পেছন পেছন গিয়ে ইহুদি, জিপসী বা অন্যান্য সংখ্যা লঘুদেরকে ধরে নিয়ে যেত ক্যাম্পগুলোয়। SS বাহিনীর সদস্যরা ছিল সাধারন জার্মান থেকে শুরু করে অধিকৃত অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়ার লোকজনও। অনেক সময় পাড়া-প্রতিবেশীরাও ইহুদিদেরকে ধরিয়ে দিতে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা নিত। যুদ্ধ শেষে অল্প কিছু নাত্সী নেতার শাস্তি দেয়া হয়, হত্যাকান্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের বেশীরভাগেরই কোন শাস্তিহয় নি।
আমার উপসংহার হচ্ছে এরকম, গনহত্যায় সাধারন জার্মান বা অস্ট্রিয়ানের যথেষ্ঠ ভুমিকা আছে, যদিও মিডিয়ায় এই তথ্যটা কৌশলে ছোট করে দেখা হয়। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদী চেতনা ত্রিশের দশকে জার্মানদের মধ্যে দারুনভাবে কাজ করেছিল, এতদিন পরে আমাদের বিশ্লেষনে তাদের কর্মকান্ড অপরাধমুলক মনে হলেও, সে সময় জার্মান নাগরিকদের মানসে নিজেদের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠার জন্য গনহত্যাকেও বৈধ এবং প্রয়োজনীয় মনে হত। Nuremberg Trial-এ ধৃত নাত্সী নেতারা তাদের কৃতকর্মের জন্য সামান্য অনুতপ্তও ছিল না। ব্যাক্তিগত জীবনে এদের অনেকেই ছিল স্বাভাবিক মানুষ, যেমন Auschwitz SS Kommandant Rudolf Hoess -এর ক্ষেত্রে, সন্তানবত্সল, ফ্যামিলিম্যান অ¨াটিচুডের এই লোকটাই যে দিনে ১০০০০ লোককে গ্যাসচে¤^ারে পাঠাত না জানলে বিশ্বাস করা কঠিন।
পরবর্তি "মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ" লেখাগুলোতে মানুষ হিসেবে আমাদের গনহত্যা প্রবনতা এবং এ সম্পর্কিত সহজাত বৈপরিত্যগুলো আরো তুলে ধরব। আশা করি কয়েকটা উদাহরনের পরে সমস্যার মুল উত্স পরিষ্কার হয়ে উঠবে
1 Comments:
জার্মানরা সব মিলিয়ে প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষকে কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে হত্যা করেছিল । যাদের ভিতর দুই তৃতীয়াংশ ছিল ইহুদী । কিন্তু শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে যুদ্ধে অক্ষশক্তি হারলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মোট মৃতের মাত্র ২০ শতাংশ ছিল অক্ষশক্তির । যুদ্ধে মিত্রশক্তির ক্ষয়ক্ষতি অক্ষশক্তির থেকে বহু বেশী হয়েছিল ।
যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সবথেকে বেশী লোক নিহত হয়েছিল । তাদের প্রায় দু কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষ নিহত হয় ।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া ।
nanarokom.blogspot.com
Post a Comment
<< Home