এবু গোগোঃ Homo Floresiensis না কেবলই রুপকথা?
এবু গোগো (ebu gogo), যার মানে দাড়াচ্ছে "the grandmother who eats anything", ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপের গ্রামবাসীদের মধ্যে এবু গোগোর কাহিনী বহুকাল ধরেই প্রচলিত। মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু ছোটখাটো শরীর, অদ্ভুত হাটার ধরন, বিড়বিড়িয়ে কথা বলা আর পেটুক স্বভাব লোককাহিনীর এবু গোগোর বৈশিষ্ট্য। স্রেফ উপকথা হিসেবেই হয়তো একে উড়িয়ে দেয়া যেত, বাধ সাধল দু বছর আগে আবিষ্কার করা কিছু ফসিল।
একধরনের হবিট (লিলিপুট) জাতীয় মানুষের এসব ফসিল প্রায় ১৩,০০০ বছরের পুরোনো। ফ্লোরেস দ্বীপের এসব ফসিল গত কয়েক বছরের প্যালিও-এনথেªাপলজির বড় আবিষ্কার গুলোর একটা, এর আগে ধারনা করা হচ্ছিল গত ২৫,০০০ বছর ধরে মানুষের একটাই প্রজাতি জীবিত আছে। ইউরোপে নিয়ান্ডারথাল এবং এশিয়াতে হোমো ইরেকটাসের অন্তর্ধানের পর আমরা মোটামুটি একাই পৃথিবীতে আছি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে এত ছোট আকারের মানুষ গত কয়েক লাখ বছরে ছিল বলে জানা যায় না, যদিও প্রায় ৩০ লাখ বছর আগে পাওয়া অস্ট্রালোপিথেকাস (যেমন লুসি'র ফসিল, ইথিওপিয়াতে পাওয়া) অনেকটা এরকম ছিল, কিন্তু এবু গোগোর ফসিল তো মাত্র ১৩ হাজার বছর পুরোনো।
ফ্লোরেস দ্বীপে অবশ্য এর আগেও আশ্চর্যজনক সব ফসিল পাওয়া গেছে। ১৯৯৮ এ একদল archaeologists আট লক্ষ বছরের পুরোনো পাথরের তৈরী স্থুল হাতিয়ার আবিষ্কার করেন, যদিও সমসাময়িক কোন মানুষের ফসিল পাওয়া যায় নি। আধুনিক মানুষ সর্বো”চ দেড় লাখ বছর ধরে পৃথিবীতে আছে, তার মানে দাড়াচ্ছে এ সব হাতিয়ার হোমো ইরেকটাসের তৈরী করা। হোমো ইরেকটাসের ব্যাপারটা বোধ হয় পরিষ্কার করা দরকার, আমার জিনতত্ত্ব এবং বিবর্তন বাদ নিয়ে পুরোনো লেখায় এদের নাম মনে হয় না উল্লেখ করেছি, বরং আমি লিখেছি মানুষ ৭০-৮০ হাজার বছর আগে প্রথম আফ্রিকা থেকে বের হয়ে আসে। আসলে মানুষ বলতে আমি বুঝিয়েছি আমাদের সরাসরি পুর্বপুরুষকে (Homo sapiens sapiens), কিন্তু এরাই মানুষের একমাত্র ধারা নয়, এছাড়া আমাদের প ূর্বপুরুষেরও পুর্বপুরুষ ছিল। এসব নিয়ে বিস্তারিত পরে লিখব, আপাতত সংক্ষেপে লিখলে দাড়াচ্ছে এরকমঃ ৩০-৪০ লক্ষ বছর আগে পুর্ব ও দক্ষিন আফ্রিকায় মানুষের পুর্বপুরুষরা ছিল, এরা অবশ্য বৈশিষ্টে আধুনিক মানুষের কাছাকাছি হলেও অনেক পার্থক্যও আছে, এদের একদল হচ্ছে হোমো ইরেকটাস (খাড়া মানুষ)। প্লাইস্টোসিন বরফ যুগে (২০ লাখ বছর আগে) এরা আফ্রিকার বাইরেও ছড়িয়ে পরে, তবে এদের একদল আফ্রিকায় থেকে গিয়েছিল যাদের থেকে গত ২-৩ লাখ বছর আগে আমাদের উত্পত্তি ঘটেছে, অন্যদিকে যারা আফ্রিকার বাইরে এসেছিল তারা বর্তমান ইউরোপ, চিন, দক্ষিন এশিয়াতে (ইউরোপ, ভারত, জাভা, চীনে এদের ফসিল আছে) বসতি স্থাপন করে। হোমো ইরেকটাস পাথরের হাতিয়ার বানাতে পারত, সম্ভবত সীমিত ভাষা এবং আগুনের ব্যবহারও জানত। যাহোক এদের ইউরোপিয়ান শাখা থেকে কালক্রমে নিয়ান্ডারথালদের উত্পত্তি। বিজ্ঞানীদের ধারনা এবু গোগো (Homo floresiensis) দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার হোমো ইরেকটাস থেকে বিবর্তিত হয়েছে। আধুনিক মানুষ যখন আফ্রিকা ৭০/৮০ হাজার বছর আগে থেকে বের হয়ে ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত বা ইউরোপে বসতি স্থাপন শুরু করে তখন আস্তে আস্তে হোমো ইরেকটাস বা তাদের বংশধররা বিলুপ্ত হতে থাকে। হতে পারে মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠেনি বা অন্য কোন কারনে এরা বিলুপ্ত হয়েছে।
যাহোক Homo floresiensis-এর সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দিপক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর আকার, পুর্ন বয়ষ্ক ফ্লোরেস মানবের উ”চতা ছিল ৩ ফুটের সামান্য বেশী (৪-৫ বছরের শিশুদের সমান) এবং ওজন ৩০ পাউন্ড (ছবি -২)। স্বাভাবিক ভাবেই এদের মস্তিষ্কের আকারও ছোট। কিন্তু ফো¬রেস দ্বীপে পাওয়া অন্যান্য পাথরের হাতিয়ার থেকে মনে হয় বুদ্ধিবৃত্তিতে এরা খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। মোটামুটি নিশ্চতভাবেই এরা আগুনের ব্যবহার জানত। সমস্যা হচ্ছে হোমো ইরেকটাস যদি এদের পুর্বপুরষ হয়ে থাকে তাহলে ফ্লোরেস মানবদের আকার এত অস্বাভাবিকভাবে ছোট কেন (হোমো ইরেকটাসের অন্যান্য ফসিলের চেয়েও ছোট)? একটা কারন হতে পারে হবিটরা এই দ্বীপে অনেকদিন ধরে আটকে ছিল, সাধারনত ছোট দ্বীপে প্রানীদের আকারও ছোট হয়ে যায় (বিবর্তনের কারনে)। ছোট দ্বীপে বড় আকারের মাংসাশী প্রানী থাকে না, তাই বড় আকৃতি তেমন কোন সাহায্য করে না, অন্যদিকে বড় আকৃতি থাকলে তুলনা মুলক ভাবে খাবার দরকার হবে বেশী, এবং দ্বীপের সীমিত স্থানে খাবারও সীমিত , এসব কারনে ন্যাচারাল সিলেকশন ক্ষুদ্রাকৃতিকে প্রাধান্য দিতে থাকে, কয়েক হাজার জেনারেশনে প্রানীরা ক্রমশ ছোট হয়ে যায়। হবিটরা ছাড়াও একই দ্বীপে ক্ষুদ্রাকৃতির হাতির ফসিল ( পিগমি স্টেগোডন, এখন বিলুপ্ত) পাওয়া গেছে। পিগমি স্টেগোডন অন্যান্য হাতির তুলনায় কয়েকগুন ছোট, উদ্ধারকৃত হাড়-গোড় থেকে মনে হয়, হবিটরা এই হাতি শিকার করত।
ফ্লোরেস মানব কিভাবে বিলুপ্ত হলো তার উত্তর পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।যে সব ফসিল পাওয়া গেছে সেগুলো ৯৫,০০০-১৩,০০০ হাজার বছরের মধ্যে, এতে মনে হয় ১২,০০০ হাজার বছর আগে ঐ এলাকায় যে বড় আগেœয়গিরির অগœুত্পাত হয়েছিল তাতে হবিটরা, পিগমী স্টেগোডন সহ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথবা এমন হতে পারে অল্প কয়েকজন হয়তো ফ্লোরেস দ্বীপের পুর্বাংশে এখনও বেচে আছে। এবু গোগোর গল্প বিশ্বাস করলে গত শতকেও এদেরকে দেখা গেছে। মালয় উপকথা অনুযায়ী সুমাত্রাতে একই রকম মানুষ সদৃশ প্রানী orang pendek দেখা যেত। কে জানে হয়ত ভবিষ্যতে জীবন্ত এবু গোগো কে খুজে পাওয়া যাবে, নিঃসন্দেহে সেটা হবে এ শতাব্দির বড় আবিষ্কার গুলোর একটা।
0 Comments:
Post a Comment
<< Home