Saturday, July 22, 2006

পর্যবেক্ষন- গনিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ ৮০তম

৪৭তম গনিত অলিম্পিয়াডে ১২৪ টি দলের মধ্যে বাংলাদেশ ৮০তম স্থান লাভ করেছে, গতবারের তুলনায় ভালো, আমার যতদুর মনে পড়ে গতবার বাংলাদেশ শেষের দিক থেকে পাঁচের মধ্যে ছিল। প্রথম আলোর লেখায় দেখতে পাচ্ছি অনেক জায়গায় এই নিয়ে মিষ্টি বিতরনও হয়েছে, ৮০ তম স্থান ঠিক উত্সব করার মতো সাফল্য কি না বুঝতে পারছি না, আজকে অধ্যাপক জাফর ইকবালও এ বিষয়ে লিখেছেন, তিনিও এই অর্জনকে সাফল্য হিসেবেই দেখছেন। আসলে সবরকম প্রতিযোগিতায় আমরা শেষ স্থান নিয়ে কাড়াকাড়ি করি, সে তুলনায় ভালো বলতেই হয়, যেমন ফুটবলে আমরা ১৪৩ তম, ক্রিকেটে শেষ দুই দলের একটি। তারপরও মন থেকে খটকা যায় না, ৪২টি সমস্যার মধ্যে যারা একতৃতীয়াংশের চেয়ে বেশী সমস্যা সমাধান করেছে তারাই পদক পেয়েছে, ১৫ কোটি লোকের দেশ আমাদের এর মধ্যে এমন একজন প্রতিযোগীও পাওয়া গেল না যে অন্তত ১৫টি সমস্যার সমাধান করতে পারে? আমি প্রথম আলো, ডাচবাংলা ব্যাংক অথবা বাংলাদেশের গনিত অলিম্পিয়াডের সাথে জড়িত শিক্ষক, কর্মকর্তাদের দোষ দিতে চাই না, আর বাংলাদেশে মুখস্থ বিদ্যা ভিত্তিক পড়াশোনা হয়তো সেটাও দায়ী। তবে এ কথাও সত্য বাংলাদেশ দলের ছাত্রছাত্রীরা হঠাত্ করেই প্রতিযোগীতায় যায় নি, জেলা, বিভাগ স্তরে কয়েক বছর ধরেই প্রতিযোগীতা হচ্ছে, বাছাইকৃত প্রতিযোগীরা আলাদাভাবে প্রশিক্ষনও নিয়েছে। জনসংখ্যায় আমরা পৃথিবীতে ৭ম, অথচ অংক করতে গিয়ে হয়ে বসলাম ৮০তম। বাংলাদেশ প্রোগ্রামিং কনটেস্টেও অংশগ্রহন করে, সেখানেও সাফল্য খুব সীমিত (অবশ্য ম্যাথ অলিম্পিয়াডের চেয়ে অনেক ভালো)। জনসংখ্যার সাথে আমাদের ফলাফলের আকাশ-পাতাল পার্থক্য নিয়ে চিন্তা করছিলাম, শিক্ষা ব্যবস্থা একটা কারন, তবে আমার কেন যেন মনে হয় এটা মুল কারন নয়, আরও ব্যপার আছে।

সাব-আরবান সানফ্রান্সিসকো বে এরিয়াতে অনেক ছোট শহর আছে যেগুলোতে গেলে মনে হয় যুক্তরাষ্টেª আছি না ভারতে আছি। পুরো হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিতেই ভারতীয়দের আধিপত্য, এরপর বোধ হয় আছে চীন, এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো । যুক্তরাষ্টª বা পশ্চিম ইউরোপের সাথে তুলনা করলে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন আহামরী কিছু নয়, বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে, তারপর দারিদ্রের সমস্যা তো আছেই। তবে ভারতের সুবিধা হচ্ছে এর জনসংখ্যা যুক্তরাষ্টেªর তিনগুনেরও বেশী, যুক্তরাষ্টেª একজন মেধাবী শিশু জন্মালে ভারতে জন্মায় তিনজন, চীনে আরও তিনজন। ঢাকা কলেজের দেয়ালে একটা লেখা দেখতাম "প্রতিভা সৃষ্টি করা যায় না, প্রতিভার জন্ম হয়", কার উদ্ধৃতি ঠিক জানি না, কথাটার গুরুত্ব এখানে যে ন্যাচারাল ট্যালেন্টের সাথে ট্রেইনিং, কোচিং এর পেরে ওঠা কঠিন, এক পর্যায়ে অসম্ভব। ট্রেইনিং দিয়ে আইনস্টাইন বা ম্যারাডোনা তৈরী করা যায় না, এটাই হচ্ছে সমস্যা। ভারত এবং চীনের এই একটা সুবিধা যে তাদের কাছে ন্যাচারাল ট্যালেন্টের সবচেয়ে বড় রিজার্ভ আছে, অবকাঠামোর অভাবে সবাইকে সুবিধা দিতে পারে না, যে কয়জনকে পারে তাদেরকে নিয়েই বাকী বিশ্বকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ স্ট্যাটিস্টিকালি বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম রিজার্ভ নিয়েও ১৪তম না ২৮তমও না, একদম ৮০তম অবস্থানে কেন?

আমাদের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগে ৪৫জন নেয়া হত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বোধ হয় বাংলাদেশের একমাত্র দুর্নিতীমুক্ত পরীক্ষা, যাহোক ফলাফলের ক্রমানুসারে ঐ বছর প্রথম ৫৫ জন থেকেই ৪৫ পুর্ন হয়ে যায়। তর্কের খাতিরে ধরে নেই বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ৯০% ভাগ বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দেয়। এক পর্যায়ে ক¬াস শুরু হওয়ার পর লক্ষ্য করলাম আমাদের ৭৫-৮০ভাগ ঢাকা শহরের ছেলেমেয়ে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই দেখে দেখে ঢাকায় জন্মায় না, ঢাকার জনসংখ্যা দেশের মাত্র ৬%, তারওপর আমাদের সবাই সচ্ছল পরিবার থেকে এসেছি, অনেকেই উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে। ঢাকার মোট জনসংখ্যার ঠিক কতভাগকে এ ধরনের পরিবার বলা যায় আমার ঠিক জানা নেই, তবে ২৫% এর কম হবে বলেই মনে হয়। তার মানে দাড়াচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সব ছাত্ররা আসে তারা আসলে দেশের সত্যিকার জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী নয়, বিশেষ করে যারা উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করে বা ভর্তিতে ভালো করার সুযোগ পায়।

এতদুর চিন্তা করার পর ৮০তম অবস্থানের ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে লাগল। আসলে গনিত অলিম্পয়াডই হোক আর শিক্ষা ভিত্তিক প্রতিযোগীতাই হোক, প্রতিযোগীরা আসলে দেশের ৮-১০% অন্তত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। তার মানে এসব ক্ষেত্রে আমরা ১৫ কোটির পরিবর্তে এক কোটি লোকের প্রতিনিধিত্ব করি। আমি পপুলেশন চার্টে খুজতে লাগলাম ১ কোটি জনসংখ্যার দেশ কোনটি ... এরকম একটা দেশ হচ্ছে সার্বিয়া (১,০১,৬০,১৯৫) এবং তার অবস্থান ঠিক ৮০তম। একটু কাকতালীয় হয়ে গেল বটে, আর উপরের হিসাবগুলোতে সরলীকরনের আশªয় নেয়া হয়েছে, তবে তাতে মুল বক্তব্য কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, আমাদের ট্যালেন্ট পুলের ৮০%-৯০% অব্যবহৃত।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে যাদের যে সামর্থ্য নেই ট্রেইনিং, অবকাঠামোর উন্নয়ন কোন কিছু দিয়েই সামর্থ্যের ঘাটতি একটা পর্যায়ের পরে আর পুরন করা যায় না। আমি বলছি না যে ম্যাথ দলের সদস্যরা অযোগ্য ছিল, আমার বিশ্বাস এত বড় জনসংখ্যার দেশে আরো যোগ্য ছেলেমেয়ে থাকার কথা, তবে হয়তো সে অংক কষার পরিবর্তে কাওরান বাজারে তরকারী বিক্রি করে, অথবা আরিচা ঘাটের বাদাম ওয়ালা অথবা কোথাও কোন বাসার কাজের মেয়ে। ব্লগে অনেকে মুখস্থ বিদ্যা দুর করার কথা বলেছেন, শিক্ষা ব্যাবস্থার আধুনিকায়নের কথা বলেছেন সেগুলো ঠিক আছে, তবে দেশের জন্য সবচেয়ে দরকারী এই আনট্যাপড ন্যাচারাল রিসোর্সের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মেধাগুলোর নিদারুন অপচয় রোধ না করতে পারলে আমাদেরকে পিছনের কাতারেই বসে থাকতে হবে।


(অসম্পুর্ন ... পরে আরো লিখব)
Original blog with comments: http://www.somewhereinblog.net/utsablog/post/14103

0 Comments:

Post a Comment

<< Home

eXTReMe Tracker