দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালাঃ অ্যাংকরেজ, আলাস্কা (২)
মাঝরাতে গিয়ে পৌছলাম অ্যাংকরেজে৷ রেন্টাল কার নিতে গিয়ে দেখি গাড়ি নাই৷ মিড সাইজ গাড়ি রিজার্ভেশন দিয়েছিলাম, অনেক ঘাটাঘাটি করে বললো এত রাতে ৭ সিটের ভ্যান ছাড়া আর কিছু দিতে পারবে না৷ মডেল ডজ ক্যারাভান৷ মনে মনে খুশীই হলাম, যদিও মুখে প্রকাশ করলাম না, কারন বড় গাড়িতে একটু আরাম করে ঘোরা যায়৷ ডজের গাড়ি গাড়িটায় পেছনের সিটে চাইলে একজন শুয়ে ঘুমাতেও পারে৷ একটা সিদ্ধান্ত আমার প্রায়ই ভুল হতো, সেট হচ্ছে খুজে খুজে একদম সস্তা মোটেলে ওঠা৷ আসলে সামান্য একটু বেশী খরচ করলে তুলনামুলক ভাবে অনেক ভাল হোটেলে থাকা যায়৷ যাইহোক অলাস্কায় নির্জন রাতে গাড়ি নিয়ে মোটেলের দিকে রওনা হলাম৷ বেশ একটু ভয় ভয় করছিল৷ এয়ারপোর্ট থেকে মোটেল ৫-৭ মাইল দুরে, রাস্তায় কোন লোকজন থাক দুরের কথা, গাড়িও খুব কম৷
মোটেলের রিসেপশনিস্ট বিরক্তভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল৷ বাইরে যেমন ভাঙাচোরা অবস্থা ভিতরে আরও খারাপ৷ এসব মোটেলে বিছানায় প্রায়ই মানুষের লোম পড়ে থাকে, এজন্য এবার বাসা থেকে চাদর নিয়ে এসেছি৷ ব্যাগ থেকে ক্যামেরা, ফোন, ল্যাপটপ বের করে চার্জে দিয়ে দিলাম৷ প্লেনে তোলা অরোরার ছবিগুলো ল্যাপটপে ট্রান্সফার করে দেখার চেষ্টা করলাম, পুরান ল্যাপটপের এলসিডিতে দেখাই যাচ্ছিল না, মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল৷ আলাস্কা GMT-9 টাইম জোনে, রাত দুটার দিকে যখন ঘুমাতে যাচ্ছি তখন আমার বায়োলজিকাল ঘড়িতে প্রায় ভোর হয় হয়৷
ফোনের চি্তকারে ঘুম ভাঙ্গলো, আমার বন্ধু তার দল নিয়ে রওনা দিচ্ছে৷ রওনা দেয়ার খবর এত ঘটা করে জানানোর দরকার ছিল না, কাচা ঘুমটা ভেঙ্গে শরীর খারাপ লাগছিল৷ বাথরুমে বসে একটু কসরত করলাম, আসলে এত নোংরা মনে হচ্ছিল যে ছেলে হয়েও খুব বেশীক্ষন বসে থাকতে ভাল লাগছিল না৷ আরেকটু গড়াগড়ি করে গোসল করে ব্যাগট্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম৷
এই মোটেলে কোন ব্রেকফাস্ট নেই৷ বিল দিয়ে বের হয়ে আসলাম৷ একটা বিশাল বড় লিস্ট নিয়ে আসছি আলাস্কায় কি কি করব, আসলে বলতে গেলে ৭০-৮০ পৃষ্ঠার চোথা৷ নানা রকম অল্টারনেট হিসাব করা আছে ওখানে৷ অ্যাংকরেজ ঠিক সরাসরি প্যাসিফিকের (এক্ষেত্রে গাল্ফ অফ আলাস্কা) পাড়ে না, বরং বাংলাদেশে বরিশাল যেমন কিছুটা ভেতরে অনেকটা ওরকম৷ ওরা নাম দিয়েছে কুক ইনলেট৷ এর আবার দুটা শাখা নিক আর টার্নএগেইন আর্ম৷ একটা দেড় ঘন্টার লঞ্চ (এখানকার ভাষায় Ferry) ট্যুর আছে আশে পাশের গ্লেসিয়ার গুলোতে, সকালে দেখি ঐটা ধরা যায় কি না৷
প্রচুর ওয়ান ওয়ে রাস্তা এইখানে, এম্নিতেই নতুন জায়গায় আমি পথঘাট চিনতে পারি না৷ আমার চোথা অনুযায়ী যেখানে লঞ্চঘাট হওয়ার কথা সেখানে এসে দেখি একটা বড় হোটেল, আশে পাশে কোন নদী বা এরকম কিছু নেই৷ ব্যপার কি৷ ফোন করার পর টিকেট বিক্রেতা মহিলা বলল আসলে হোটেলটা হচ্ছে টিকেট কাঊন্টার, সত্যিকার লঞ্চঘাট এখান থেকে এক ঘন্টার ড্রাইভ (৫০ মাইল দুরে)৷ বলে কি এই মহিলা৷ ফেরী ছাড়তে আর সময় আছে ১৫ মিনিট৷ মনটা খারাপ হয়ে গেল, প্ল্যান করে আসছি কুক ইনলেট ঘুরে দেখব, ধুত্তোর৷
অ্যংকরেজ মিউজিয়ামে গেলাম৷ চমত্কার করে সাজানো৷ আলাস্কার আদিবাসীদের মধ্যে আছে এস্কিমো (ইনুইট), আথাবাস্কান আর আলিউট৷ ১৫/১৬ হাজার বছর আগে সাইবেরিয়া থেকে বেরিঙ প্রনালী, আলাস্কা হয়ে মানুষ প্রথম আমেরিকা তে আসে৷ এদের বংশধররাই এখনো আলাস্কায় আছে, আর যারা আরো দক্ষিনে গিয়েছিল তাদের থেকে কালক্রমে আজটেক, মায়া, বা ইনকাদের জন্ম হয়েছে৷ যাদুঘরে চমত্কার সব নিদর্শন আছে এই মাইগ্রেশনের৷ প্রাগৈতিহাসিক সময়ে (১০ হাজার বছর বা তার আগে) এসব এলাকায় ম্যামথ, ঊলি রাইনো (লোমশ গন্ডার) ছিল৷ ইনুইটদের তৈরী ম্যমথের (বরফ যুগের লোমশ হাতি) দাত বা হাড় থেকে বানানো অনেক সরঞ্জাম দেখলাম৷
দুপুরে আমাদের দলের বাকীরা এলে আবার এয়ারপোর্ট যেতে হলো৷ পথে যেতে যেতে দিগন্তে চুগাছ (Chugach) পর্বতমালা দেখা যাচ্ছিল, হঠাত্ কেন যেন ঠিক রাঙামাটির পাহাড়গুলোর মতো মনে হচ্ছিল৷ এতদিন এখানে পাহাড় বলতে রকি মাউন্টেইন স্টাইলটাই মনে হতো, আলাস্কার পাহাড়গুলো কোনভাবে মেইনল্যান্ডের চেয়ে আলাদা৷ পরের দিন গুলোতে ডেনালী বা্ Wrangle-St Elias এও একই ব্যাপার খেয়াল করেছি৷ যাহোক পুরো দল একসাথে হয়ে পেট ভরে খেয়ে নিলাম, এক ফাকে আমি ওয়ালমার্ট থেকে ব্ল্যাংক সিডি কিনে নিলাম, প্রতিদিনের ছবি প্রতিদিন সিডিতে লিখে রাখব, নাহলে কখন ল্যাপটপের হার্ডড্রাইভ ক্র্যাশ করে কে জানে৷
এখন গন্তব্য ডেনালী ন্যাশনাল পার্ক৷ ডেনালীতে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে ঊচু পর্বতের চুড়া আছে (মাউন্ট ম্যাকিনলী ২০,৩২০ ফিট, এভারেস্ট ২৯,০০০) কিন্তু ম্যাকিনলী দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার, কারন বছরের বেশীরভাগ সময়েই মেঘে ঢাকা থাকে, বিশেষ করে বছরের এই সময়ে তো দেখা আরো কঠিন৷ আলাস্কাতে ফ্রীওয়ে কম, বা সেভাবে নাই বল্লেই চলে৷ কে চালাবে এই নিয়ে একটু বিতন্ডা হচ্ছিল, সবাই টায়ার্ড, ঝামেলা কমাতে রাজী হয়ে গেলাম৷
বন্ধুদের কারো কারো সাথে বেশ অনেকদিন পরেই দেখা৷ সবাই সবার ব্যাপারে আপডেট নিচ্ছিল, কে কি করল, কদ্দুর এগোলো ক্যারিয়ার, কেউ কেউ সংখ্যা বাড়নোর চেষ্টায় আছে, কিন্তু এক আর একে ঠিক তিন হচ্ছে না ইত্যাদি৷ ওয়েবে অনেক ছবি দেখে এসেছি ডেনালীর এবং ডেনালী যাওয়ার পথের৷ শুরুতে খুব একটা সুবিধা হচ্ছিল না, সেই একই ফার, পাইন গাছের সারি, পার্মা ফ্রস্টে রঙচঙা গুল্মের কোন খোজ নেই৷
এ্যাংকরেজ থেকে ডেনালী ৪০০ কিমি, পাচ ঘন্টার রাস্তা৷ রাতে না ঘুমিয়ে চালাতে একটু খারাপ লাগছিল, আবার রাস্তায় সবজায়গায় ডিভাইডার নেই, বিপরীত দিক থেকে লরী আসতে দেখলে একটু ভয়ই লাগে৷ আড়াইটা-তিনটার দিকে রওনা দিয়েছিলাম, একসময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সেখান থেকে সন্ধ্যা হবার জোগাড়, এখনও না কোন উল্লেখযোগ্য প্রানী না সেই রঙিন বেরী (জাম?) গুল্ম৷ ঠিক তখনই দেখি একটা Moose (তাড়াহুড়ায় ছবি তোলা হয় নি) রাস্তা পার হচ্ছে৷ আমাদের দেখে বেচারা দিল দৌড়, দৌড় দিয়েই ভালো করেছে অবশ্য কারন ধাক্কা লাগলে দুর্ঘটনা হতে পারত৷ একবার হরিনের সাথে ধাক্কা লেগে যে অবস্থা হয়েছিল, এরপর আর কোনদিন এসব বোকারামকে ধাক্কা দিতে চাই না৷ এরপরই যেন ভাগ্য খুলে গেল আমাদের৷ পাইন আর ফারের বন পরিষ্কার হয়ে একটু খোলা জায়গায় চলে আসলাম৷ রাস্তার দুপাশেই বেশ দুরে পাহাড়, তার আগে খোলা মাঠের মতো (meadow), আর মাঠ ভর্তি নানা রঙের বেরী জাতীয় গুল্ম৷ আলাস্কায় ঠান্ডার জন্য মাটির নিচে একটু গভীরে যে বরফ থাকে সেটা কখনই গলে না৷ এরা বলে পার্মাফ্রস্ট৷ বরফের জন্য বড় গাছ জন্মাতে পারে না, সে জন্য জন্মায় ঘাস বা নানা জাতের ছোট উদ্ভিদ৷
কি যে অপার্থিব দৃশ্য খালি চোখে না দেখলে বোঝা মুস্কিল৷ ক্যামেরার সাধ্য নেই এই ছবি তুলে ধরার৷ ডেনালী পর্বতমালার ব্যাকড্রপে মনে হচ্ছিল আলাস্কা আসার ৫০% অলরেডি সার্থক৷
Labels: Alaska, Anchorage. Denali
0 Comments:
Post a Comment
<< Home