আলাস্কা নিয়ে আমার ভ্রমন কাহিনীটা আর শেষ হচ্ছে না৷ নানা কারনে লেখা হয়ে ওঠে না, লিখতে ভালোও লাগে না, আবার ওদিকে লিখে রাখতে চাই৷ টাইম ক্যাপসুল৷ যদিও বেশীরভাগ উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ডায়ালগ ভিডিওতে তুলে রেখেছি, তাও লিখিত অবস্থায় রাখলে পরে অল্টারনেট সোর্স হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে৷
পঞ্চম দিনটা বোধহয় সবচেয়ে কম ঘটনা বহুল দিন৷ বেশীরভাগ সময় গেছে ড্রাইভ করতে করতে৷ ফেয়ারবব্যাংক্স থেকে অ্যাংকরেজে আবার ফিরে আসলাম আমরা ওইদিন৷ আগের রাতে অরোরা দেখে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, ঘুমোতে ঘুমোতে আড়াইটা তিনটা৷ সকালে বেশ বেলা করে উঠলাম৷ ডেনী’স এ পেট পুরে ব্রাঞ্চ (সকাল আর দুপুরের খাওয়া একসাথে) খেয়ে রওনা দিতে দিতে ১১টার বেশী বেজে গেল৷ গোটা রাস্তা ৪২৮ মাইল (প্রায় ৭০০ কিমি)৷ একটানা চালালেও ৮ ঘন্টার বেশী লাগার কথা৷ হাইওয়ে ২ ধরলাম, গন্তব্য ডেল্টা জাংশন৷ ডেল্টা জাংশন থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে দক্ষিন পশ্চিমে কানাডার ইউকন টেরিটরির দিকে, আর আরেকটা ভালডেজ/অ্যাংকরেজের দিকে৷ দিনটা বেশ পরিস্কার ছিল৷ সামনে দক্ষিন দিগন্ত বরাবর মাতানুষ্কা-সাস্তিনা পর্বতমালা৷ তিনটি চুড়া মাউন্ট ডেবরা, মাউন্ট হেস, আর মাউন্ট মোফিট বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল৷ এরকম আকাশ থাকলে কে জানে হয়তো মাউন্ট ম্যকিনলীও দেখতে পেতাম৷ ম্যাকিনলী না দেখতে পাওয়াটা বেশ দুঃখজনক ছিল সেবার৷
ডেল্টা জাংশন পর্যন্ত রাস্তায় অনেক গাড়ী৷ কাছেই কোথাও আর্মিদের ক্যাম্প আছে৷ আর বেশ স্বাস্থ্যবান তানানা নদী৷ অনেক জায়গায় থামলাম আমরা৷ আমি ছাড়া সবাই বেশ আপবিট৷ আমি একটু টেনশনে ছিলাম দেরী হয়ে যাচ্ছে কি না৷ ওই দিনের আমার একটা টার্গেট ছিল বিকাল পাচটার আগে Wrangell-St Elias National Park এ পৌছুনো৷ যেভাবে যাত্রা বিরতি হচ্ছিল, ইলিয়াস মিস হতে পারে ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলাম৷ দুটোর দিকে বা আরও পরে ডেল্টা জাংশনে পৌছলাম৷ হাইওয়ে-২ কানাডার দিকে গিয়েছে, আমরা নেবো হাইওয়ে-৪৷ রাস্তায় উঠেই বুঝলাম এ রাস্তায় লোকজন তেমন নেই৷ অথবা একদমই নেই৷ কোন লোকালয় বা জনবসতিও নেই৷ সাস্তিনা পর্বতমালা পার হয়ে গেলাম এক সময়৷ দুপাশে প্রাকৃতিক দৃশ্য বলতে হয় মারাত্মক৷ পুরো ট্যুরের সবচেয়ে ভালো ছবিগুলোর কয়েকটা তুলেছি এখানে৷ মেয়েদের অনেকের বাথরুম চেপে বসলো এর মধ্যে৷ কোন বসতি নিদেনপক্ষে কোন গ্যাসস্টেশনও নেই৷ অনেকক্ষন পর একটা ট্রেলারের মধ্যে দোকানের দেখা পাওয়া গেল৷ এই বিরান এলাকায় এই লোক থাকে কিভাবে কে জানে৷ কোন ইলেক্ট্রিসিটি কানেকশনও নেই৷ নিজেরা জেনারেটর দিয়ে যতটুকু পারে৷
দিগন্তে আস্তে আস্তে Wrangell-St Elias এর দেখা পাওয়া গেল৷ বেশ কয়েকটা উচু চুড়া আছে এখানে৷ মাউন্ট Wrangell নিজে ১৪,১৬৩ ফিট, মাউন্ট স্যানফোর্ড ১৬,২৩৭ ফিট আর মাউন্ট ব্ল্যাকবার্ন ১৬,৩৯০ ফিট৷ মেঘের জন্য একটু কষ্ট হচ্ছিল দেখতে৷ ঘড়িতে পাচটা এর মধ্যে বেজে গেছে৷ তাও একটা ক্ষীন আশা ছিল হয়তো ট্যুরিস্ট সিজন বলে সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকতে পারে৷ ফাকা রাস্তা পেয়ে বেশ দ্রুত চালিয়ে নিলাম ভ্যানটা৷ ম্যাপে দেখাচ্ছে পরবর্তি শহর গুলকানা, গুলকানা নদীর ধারে৷ অনেকক্ষন গিয়ে শুধু একজায়গায় একটা গ্যাসস্টেশন আর একটা ছোট দোকান দেখলাম৷ এইটুকুই মনে হয় গুলকানা৷ একশ মাইলের মধ্যে এতটুকুই জনবসতি আছে মনে হয়৷
পার্কের ভিজিটর সেন্টারে যখন পৌছলাম সাতটা বেজে গেছে তখন৷ নাহ, পার্ক ৫ টাতেই বন্ধ হয়ে গেছে৷ এখানে একটা ন্যাচার ট্রেইল ছিল যেটা অনেকে রেকমেন্ড করেছে, সেটাও মিস৷ একটু হা হুতাশ করলাম৷ এই দুঘন্টা বাচানো যেত৷ আরো মিস হলো কপার রিভার৷ কপার নদীর স্যামন খুব বিখ্যাত৷ আমাদের ওখানে বেশ দাম দিয়ে কিনতে হয়৷ কি আর করা, একটু উল্টো দিকে গিয়ে অ্যাংকরেজের পথ ধরলাম৷ রাস্তার এ অংশের নাম গ্লেন হাইওয়ে৷ জনবসতি বিহীন রাস্তা, পথে একটা এয়ারপোর্ট দেখলাম শুধু, তাজলিনা এয়ারপোর্ট৷ দশটার দিকে সুর্যটা আস্তে আস্তে ডুবে যেতে লাগলো৷ টুকটাক ছবি তুললাম৷ যাত্রীরা সবাই ক্লান্ত, বিরক্তও কিছুটা৷
শীপ (ভেড়া) পর্বত পার হওয়ার পর আজকে দিনে আমার শেষ দর্শনীয় স্থান৷ অনেক দেরী হয়ে গেছে অবশ্য৷ মাতানুষ্কা গ্লেসিয়ার৷ একদম রাস্তার পাশেই৷ বেশ বড়, আর হাইওয়ে থেকে শরীরের অনেকটাই দেখা যাচ্ছিল৷
গ্লেসিয়ার পার্কে এসে থামলাম, ততক্ষনে একটু অন্ধকার হয়ে গেছে৷ হেটে গিয়ে গ্লেসিয়ারে ওঠা যায়, মাইল খানেক হাটতে হবে৷ গ্রিজলী ভালুকের দেশ৷ বাঙালী মন ঠিক সায় দিল না৷ আবার যেতেও মন চায়, দিনে এমনিতেই দিনভর অনেক ব্যর্থতা আছে৷ শেষমেশ গাড়ী নিয়ে যতদুর যাওয়া যায় গেলাম, কাচা রাস্তা, শেষমাথায় এসে আর উপায় নেই৷ বাকীটুকু হেটে যেতে হবে৷ আমি ছাড়া কেউই হাইকিং এ রাজী না৷ এমনকিও আমিও ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছি৷ ফিরেই এলাম৷ ড্রাইভার বদলালাম এক পর্যায়ে, এখনো অনেক রাস্তা বাকী, কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আর কিছু দেখা যাচ্ছে না৷
মধ্যে একটা শহর ছিল, পামার, বড় আকারের মেলা হয় এখানে৷ বিশাল সাইজের মিষ্টি কুমড়া, আর ফুলকপি নিয়ে আসে লোকে৷ সময় নেই তাই দাড়ালাম না৷ মাঝরাতে গিয়ে অ্যাংকরেজ পৌছলাম৷ ভালো হোটেল নিয়েছি এবার, সুতরাং চিন্তা নেই৷