Saturday, April 07, 2007

বাংলাদেশ ২.০ (গনতন্ত্র আর প্রযুক্তি)

বাংলাদেশে গনতন্ত্রের ইম্প্লিমেন্টেশন কেমন হলে ভাল হয়, এ নিয়ে একটা লেখা শুরু করেছিলাম গত সপ্তাহে৷ ঘটনাচক্রে তার কয়েকদিন পরেই দেশের আর্মি প্রধান বললেন বাংলাদেশের জন্য নতুন গনতন্ত্র দরকার৷ তারা ঠিক কি করবেন এটা পরিস্কার না৷ এর আগে সামরিক শাসক জিয়া বা এরশাদ এসেও তাদের ব্র্যন্ডের হ্যা-না ভোট ওয়ালা গনতন্ত্র চালু করেছিলেন, যদিও ফলাফল শুভ হয় নি৷ তবে আপাতত পেসিমিজমে না গিয়ে আরো কিছুদিন দেখা দরকার শেষমেশ কি হয়৷ জিয়া বা এরশাদ যেমন ক্ষমতাদখল করেছিলেন সরাসরি তার চেয়ে এখনকার অবস্থার পার্থক্য আছে৷ পৃথিবী যেমন বদলেছে, বাংলাদেশও ভীষন ভাবে বদলেছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আর মানুষের সচেতনতার কারনে জিয়া/এরশাদ স্টাইল দখলতন্ত্র এখন অসম্ভব৷ আর বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী এখন অনেক পেশাদার এজন্য ৭০ বা ৮০র দশকের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে একদমই মনে হয় না আমার কাছে৷ আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে মনে হয় বেশ ভালো কিছুও বের হয়ে আসার সম্ভাবনা এই প্রচেষ্টা থেকে৷ কারন অস্বীকার করা যাবে না যেভাবে নামকাওয়াস্তে গনতন্ত্র চলছিল দেশে তা বহন করা দেশের মানুষের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাড়াচ্ছিল৷

আমরা একটা পোষা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি যে সত্যিই যদি বাংলাদেশের গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাল্টানোর সুযোগ আসে তাহলে আমরা ঠিক কি করতাম৷ অথবা আরেকভাবে বললে যদি স্ক্র্যাচ থেকে ডিজাইন করার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে বর্তমান অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা কেমন ব্যবস্থা চাই, যেন দেশের প্রগতির চাকাকে ত্বরান্বিত করা যায়, একুশ শতকে প্রথমার্ধেই (যেমন ২০২০ এর আগে) আমরা স্বল্পোন্নত দুর্নাম ঘোচাতে পারি৷ হিমু তার লেখাগুলো এখানে পোস্ট করছে, http://jongli.wordpress.com/, প্রস্তাবগুলো নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে৷

তো আজকের লেখার মূল প্রসঙ্গে আসি৷ বেশ কিছুদিন ধরেই আমার ধারনা হচ্ছে গনতন্ত্র আর প্রযুক্তিগত উন্নতির মধ্যে একটা সিম্বায়োটিক রিলেশনশীপ আছে৷ তার আগে বলে নেই আমরা উন্নয়ন বলতে যা বুঝি তা আসলে ঘুরে ফিরে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন৷ যেমন গ্রামে বেড়াতে গিয়ে যদি দেখি গতবছরের কাচা রাস্তা এবার পাকা হয়েছে তখন মনে হয় কিছু উন্নতি হয়েছে, আবার যেমন ৭০ দশকে আমাদের যে খাদ্য ঘাটতি ছিল টা আর এখন নেই, যদিও দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুন হয়েছে, এটাও সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির জন্য৷ আসলে মানুষ হিসেবে অন্য প্রানীর সাথে আমাদের একটা মৌলিক পার্থক্য প্রযুক্তির ব্যবহার আর তার মাধ্যমে পরিবেশকে ক্রমশ নিজের অনুকুলে ব্যবহার করার ক্ষমতা৷ জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার আসলে সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি, বা আরো সংক্ষেপে বললে উন্নয়নের মূল ঊপকরন হচ্ছে knowledge৷

খেয়াল করলে দেখব আধুনিক বিশ্বে যেসব দেশ তাদের knowledge base বাড়িয়েছে তারাই আসলে ঊন্নতি করছে৷ উদাহরন দেই, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে পৃথিবীর ৫% লোক থাকে, কিন্তু বিশ্বের ২৫% বা তারও বেশী রিসার্চ হয় যুক্তরাষ্ট্রে, ফলাফল হিসেবে সমসাময়িক সমস্ত বড় বড় যুগান্তকারী আবিস্কার, আর প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ার ঊদ্ভাবন গুলো ঘুরে ফিরে বেশীরভাগই যুক্তরাষ্ট্রে হয়৷ যেমন এই যে ইন্টারনেট প্রযুক্তি, ইনফরমেশন টেকনোলজি প্রায় পুরোটার জন্যই কৃতিত্ত্ব পাবে যুক্তরাষ্ট্র আর তার গবেষকরা৷ আমাদের দেশে খাদ্য বিপ্লবের কথা যে বললাম একটু আগে (এবং জেনেটিকালী পরিবর্তিত শস্য), তাও কিন্তু শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং পরে তাদের অর্থায়নে৷ বড় বড় টেকনোলজি কম্পানী যেমন ইন্টেল, মাইক্রোসফ্ট বা গুগলও ওখান থেকেই শুরু করে৷ আবার মুসলিম দেশগুলোতে যেমন বিশ্বের জনসংখ্যার ২৫% বা তারও হয়তো বেশী আছে৷ কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অগ্রগতিতে এসব দেশের অবদান ৫%ও কিনা সন্দেহ৷

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিছু কিছু দেশ কেন সভ্যতার knowledge base অনেক অবদান রাখছে আবার কেউ কেউ কিছুই করছে না৷ যেমন বাংলাদেশ, গত ৩৫ বছরে বিশ্বের দরবারে আমাদের অবদান কি? আমরা যদি এই ৩৫ বছর না থাকতাম দুনিয়ার ভীষন কোন ক্ষতি হতো বলে মনে হয় না৷ আমাদের দেশে কেন টমাস এডিসন, বিল গেটস, বা রিচার্ড ডকিনসরা জন্মায় না, যতটুকু উন্নতি আমরা করেছি তাও পাশ্চাত্য থেকে ধার করা জ্ঞান দিয়ে৷ আমাদের ঊদ্ভাবনী ক্ষমতা কি এতই কম৷

এর ঊত্তর ঘাটতে গিয়ে মনে হলো, মধ্যযুগে ইউরোপেও বহুদিন সভ্যতা আটকে ছিল৷ আবার ঠিক রেনেসার পরেই ওদের চাকা তরতর করে ঘুরতে লাগলো৷ অসংখ্য নতুন আবিস্কার হলো, নিঊটন, হাইগেন্স, হুক এসময়েরই লোক৷ এর পর একে একে স্টীম এঞ্জিনের আবিস্কার, আর তার পর ম্যাসিভ ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালাইজেশন৷ হঠাত্ করে এই যে ফ্লাড গেট খুললো এর পেছনে আসলে ছিল ইউরোপে মুক্তচিন্তার আবির্ভাব, রেনেসার মাধ্যমে, চার্চের প্রভাব ক্রমশ কমে যেতে থাকলো, ধর্ম যে শেকল দিয়ে মানুষকে বেধে রেখেছিল তা আস্তে আস্তে ভেঙ্গে যেতে বাধ্য হলো৷ আর মুক্তচিন্তার শেকড় জন্মদিলো গনতন্ত্রের৷ রাজতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, ঈশ্বরতন্ত্রের তিরোধানে গনতন্ত্রের আবির্ভাবেই কিন্তু ইউরোপ বাকি বিশ্বকে যোজন যোজন পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল৷ আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র গনতন্ত্রের দ্বিতীয় দফার পুরোনো দেশগুলোর একটা (বাকীগুলোর মধ্যে আছে বৃটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি)৷

এমনকি এখনকার বিশ্বের ধনী এবং ঊন্নত দেশগুলোর সবগুলোই গনতান্ত্রিক৷ মুসলিম বিশ্বের ঊদাহরন দিলাম যে একটু আগে, এই দেশগুলোতেই গনতন্ত্রের খুব অভাব, আবার এগুলোর অনেকেই বিশ্বের দরিদ্রদেশগুলোর এক একটা৷ অনেকে তেল বিক্রি করে সাময়িকভাবে সম্পদশালী হয়েছে, তেল শেষ হলে এরা যে কোথায় যাবে বলার অপেক্ষা রাখে না৷

তো দেখা যাচ্ছে পরিস্কারভাবেই অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য উন্নতির সাথে মুক্তচিন্তা করার সুযোগ এবং গনতন্ত্রের ভীষন সরাসরি সম্পর্ক৷ আবার ঊল্টোটাও সত্যি৷ কারন গনতন্ত্র একটা ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া৷ রাজতন্ত্র বা হারেমতন্ত্র সে তুলনায় সহজ, এবং অবভিয়াস৷ মানুষ ছাড়া অন্যপ্রানীদের সামাজিক ব্যবস্থাতেও তাই, জোর যার মুল্লুক তার, সবার সমান অধিকারের ধারনা, এবং বাস্তবে সেটা নিশ্চিত করা আসলে অনেক কঠিন৷ একটা নির্দিষ্ট পরিমান প্রযুক্তিগত সাপোর্ট না থাকলে গনতন্ত্র ধরে রাখা কঠিন৷

ঠিক যে রকম হয়েছিল গ্রীক নগর সভ্যতার গনতন্ত্রের যুগে৷ আসলে এমনকি মধ্যযুগেও গনতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য, বিশ্বের করে বড় বড় সাম্রাজ্যে কোন ধরনের ইনফ্রস্ট্রাকচার ছিল না৷ সুতরাং কেউ তখন গনতন্ত্র নিয়ে হাজির হলেও কতদিন ধরে রাখতে পারত সন্দেহ আছে৷ এমনকি দু’শ বছর আগের ইউরোপের গনতন্ত্রের সাথে এখনকার ইউরোপের গনতন্ত্রের গুনগত পার্থক্য আছে৷ বিশেষ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে৷ এখন পুরো প্রক্রিয়াটা অনেক স্বচ্ছ এবং তার কারন প্রযুক্তির সুবিধা৷ যেমন রেডিও-টিভি একাই গনতন্ত্রের জন্য ভীষন সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে৷ বিভিন্ন দেশে যখন ক্যু হয় তখন আর্মি সবার আগে রেডিও টিভি দখল করে৷

সুতরাং দেখা যাচ্ছে গনতন্ত্রের প্রাথমিক সহায়ক শক্তি হচ্ছে প্রযুক্তি৷ প্রযুক্তির যতই প্রসার হচ্ছে গনতন্ত্রও তত ছড়িয়ে পড়ছে, এর একটা কারন বোধহয় প্রযুক্তি সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করে দিচ্ছে, কারন প্রযুক্তির প্রসারের একটা ফলাফল হচ্ছে, এটা সাধারন মানুষের ক্রমশ নাগালের মধ্যে চলে এসে সবাইকে সুযোগ করে দিচ্ছে জানার, বোঝার এবং মতামত প্রকাশ করার৷

এজন্য আমার ধারনা আমরা যখন নতুন কিছু করব বাংলাদেশকে নিয়ে, তখন প্রযুক্তিগত অবস্থানের দিকটা সবার আগে মাথায় রাখতে হবে৷ যেমন গনতন্ত্র নিজে কিন্তু বলে দিচ্ছে না যে ৪/৫ বছর পর পর আমাদেরকে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে, যাদের হাতে আমাদের ভাগ্য সমর্পন করতে হবে৷ বরং ঊল্টোটাই সত্যি গুটিকয়েক লোকের হাতেই যদি আমাদের ভাগ্য নির্ভর করে, তাহলে তো ঘুরে ফিরে সেই জমিদারী প্রথাই হচ্ছে, গনতন্ত্র থাকলো কই৷ পার্লামেন্টারী ব্যবস্থাটা অষ্টাদেশ শতাব্দির জন্য বেশী ঊপযোগী, বিশেষ করে রেডিও, টিভি, ফোন এসব প্রযুক্তি যখন ছিল না৷ ১৪ কোটি লোক নিয়ে তো আর সংসদ বসানো যায় না৷ সংসদ প্রথাটা সেজন্য একধরনের শর্টকাট৷ কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে, সুতরাং কাঊকে প্রতিনিধি বানিয়ে সর্বেসর্বা করার প্রয়োজন নেই৷ গত ১৫ বছরে আমরা দেখেছি বেড়া কিভাবে আমাদের দেশে ক্ষেত খেয়ে ফেলে৷ সুতরাং সময় এসেছে অষ্টাদশ শতাব্দির প্রথা বাদ দিয়ে ২১শতকের ঊপযোগী একটা সিস্টেম দাড় করানো৷

Labels:

1 Comments:

Anonymous Anonymous said...

চমতকাত বিশ্লেষোন করেছেন - একমত।

Thursday, February 21, 2008 2:50:00 AM  

Post a Comment

<< Home

eXTReMe Tracker